প্রায় ২০১১ সালের শেষ দিকের ঘটনা। অনেক স্বপ্ন নিয়ে রোমানিয়া থেকে লন্ডনে পড়তে এসেছিল আনা। হাতে তেমন অর্থকড়ি নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে উপার্জনের জন্য কাজ নিয়েছিল সে। রেস্তোরাঁতে ওয়েট্রেস হওয়া থেকে শুরু করে ক্লিনার হিসেবে কাজ করা এবং গণিতের প্রাইভেট টিউটর হওয়া, বিভিন্ন কাজ সে করছিল পড়ার জন্য টাকা জমানোর নেশায়।

একদিন একটি কাজ শেষে আরেকটি কাজে যাবার আগে হাতে খানিকটা সময় পেল। তাই নিজের ঘরে দুপুরের খাবার খেতে ফিরছিল। ফেরার পথে হাঁটতে-হাঁটতে কানে হেড-ফোন গুঁজে সে শুনছিল বিয়ন্সের গান। আনা তখন নিজের ঘরের কাছাকাছি। আর মাত্র তিন-চারটা ঘর পরেই তার ঘর। চাবি বের করতে সে ব্যাগ হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতর্কিতে কেউ একজন পেছন থেকে তার গলা পেঁচিয়ে ধরে। তারপর মুখটা চেপে ধরে এক হেঁচকা টানে তাকে তুলে ফেলল একটা গাড়ির ভেতর।
গাড়িতে তুলেই তাকে সমানে কলি-ঘুষি মারতে থাকল আর রোমানিয়ান ভাষায় বলতে লাগল, 'একদম চেঁচামেচি করবে না। যা বলি শোনো। নইলে তোমার মাকে মেরে ফেলব।'

গাড়ির ভেতরে মোট তিনজন ছিল। একজন নারী আর দুজন পুরুষ। ভীত-সন্ত্রস্ত আনা বুঝল আর জোরাজোরি করে লাভ নেই। তার হাতব্যাগটাও কেড়ে নেয়া হল। তন্ন-তন্ন করে ব্যাগের সব জিনিষপত্র ঘেঁটে দেখল তারা। এমনকি মোবাইলের কল লিস্ট, ফেসবুকের বন্ধু তালিকা কিছুই বাদ গেল না। তারপর পাসপোর্টটা নিয়ে নিল। আর সেখান থেকেই শুরু হল আনার দুঃখ গাঁথা।

                           
আনা এতই ভীত হয়ে পড়েছিল যে তাকে যখন পাচারকারীরা বিমান বন্দরে নিয়ে গেল ভয়ে সে একটা চিৎকারও পর্যন্ত দিতে পারেনি। অথচ মনে মনে সারাক্ষণ ভাবছিল পালিয়ে যাবার কথা। কান্নাকাটিতে তার চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়েছিল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, চেক-ইন অফিসার যেনো তাকে দেখে সন্দেহ করে। কিছু জিজ্ঞেস করে। কিন্তু অফিসার কিছুই জিজ্ঞেস করল না। আর তার পাচারকারী পুরুষটি এমন একটি ভাব করল যে, তারা একটি দম্পতি। একসাথে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে।

বিমানে ওঠার পর আনাকে সেই অপহরণকারী আরো ভয় দেখায়। কান্নাকাটি করতে বারণ করল। নইলে তাকে একেবারে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এত এত নিরাপত্তার মাঝেও বিমানে করে আনাকে নিয়ে যাওয়া হল আয়ারল্যান্ডে। সেখানে একটা নোংরা ঘর। ঘরের ভেতর অ্যালকোহল, ঘাম আর সিগারেটের গন্ধ। একটা টেবিলের উপর দশ-বারোটা মোবাইল ফোন। সেগুল একটার পর একটা ক্রমাগতভাবে বেজে যাচ্ছিল।

টেবিল ঘিরে ছিল কয়েকজন পুরুষ। আর ঘরের ভেতর কয়েকটি মেয়ে খুবই স্বল্প বসনে, নগ্ন অবস্থায় চলাফেরা করছিল।আনাকে সেখানে নেয়ার পরই কয়েকজন পুরুষের সাহায্যে এক নারী তার গায়ের পোশাক ছিঁড়ে ফেলল। তারপর লাল রঙের একটা ব্রা আর এক জোড়া চপ্পল জুতো তাকে পরানো হয়।

শুধু লাল রঙের ব্রা আর পেন্টি পরিয়ে তার অনেক ছবি তোলা হল। ন্যাটালিয়া, লারা, র‍্যাচেল, রুবি ইত্যাদি নানা নামে ১৮-১৯ বা ২০-২২ বছর বয়সের ট্যাগ দিয়ে তা ছেড়ে দেয়া হল ইন্টারনেটে। ৯ মাসের বন্দী জীবনে হাজার খানেক পুরুষ তার সাথে যৌন মিলন করেছে, প্রতিদিন ৭-৮ জন কখনো বা তারো বেশি। অসুস্থ হলেও রেহাই নেই, শরীর বিলাতে হত নিয়মিত, দিতে না চাইলেই মিলত শারীরিক নিরজাতন। আর কয়েকটা মেয়ের সাথে একটা ঘরে সেও ছিল বন্দী। যাদের সবার পরিণতি ছিল প্রায় একই।

সেই ঘর থেকে বেরিয়ে মাসে একবারও সূর্যের আলো দেখার সুযোগ পেত না সে। এমনও হয়েছে, দিনে ২০ জন পুরুষও এসেছে তার কাছে। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত বলে কিছু নেই। সারাক্ষণ পুরুষ মানুষের শরীর লেগেই থাকত, পুরুষরা পড়েথাক্ত তার শরীরের উপর। এমনকি আনাকে ঘুমেরও সময় দেয়া হতো না। কেবল যেই সময়টায় কোনো খদ্দের থাকতো না তখনই সে একটু ঘুমিয়ে নিত বা একটু খাবারের সুযোগ পেত।

এমনও দিন গেছে, কোনো খাবারই দেয়া হয়নি। আর খাবার হিসেবে সাধারণত দিতো দিনে এক টুকরো রুটি। আর কখনো দিত খদ্দেরের রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্ট খাবারটুকু। এভাবে দিনের পর দিন খেতে না পেরে একটা সময় আনার শরীর ভেঙে পড়া শুরু করল এবং তার মস্তিষ্কও যেনো ঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিল। প্রতিবার যৌন ক্রিয়ার পর কখনো-কখনো রক্তাক্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকত সে। মনে মনে ভাবতো, আর বুঝি বাঁচবে না।

খদ্দেরদের অনেকেই শারীরিকভাবে তাকে নির্যাতন করতো, কামড়ে ছিড়ে খেতে চাইতো। আনার সারা গায়ে ছিল দাগ আর ক্ষত চিহ্ন। পুরনো দাগ মিলিয়ে যাবার আগেই একই জায়গায় তৈরি হতো নতুন ক্ষত। পুর স্তন জুড়ে ছিল অসংখ কামড়ের ছোপ ছোপ কাল দাগ এবং কি তার যৌনাঙ্গ ছিল কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত, রক্ত আর পুঁজ পড়াও শুরু করেছিল।

 এভাবেই কিছুদিন যাবার পর একদিন পুলিশ এসে রেইড দিল সেই বাড়ি। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই অপরাধীরা সব টাকা-পয়সা নিয়ে সরে গেল। ঘরে শুধু পড়ে রইল আনা আর তার মত পাচার হয়ে আসা অন্য মেয়েরা।

এরপর থানা-পুলিশ হল। পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হল। সেই ছবি আনার মা আর প্রতিবেশীরাও দেখল। কিন্তু তারা জানল না যে, আনা বন্দী। বরং তারা জানল যে, আনা আয়ারল্যান্ডে যৌন ব্যবসা করে অনেক টাকা কামাই করছে। ছবি দেখে আনার মা আনাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করল। কিন্তু তাদের দেশের পুলিশ ব্যাপারটিকে গুরুত্বই দিল না। তারা বলল, সে প্রাপ্ত বয়স্ক। যা খুশি তা করার সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে। আনা এসব কিছুই জানল না।

তবে আইনি প্রক্রিয়া শেষে আয়ারল্যান্ডের পুলিশ আনাসহ অন্য মেয়েদের ছেড়ে দিল। কিন্তু আনা দেখল, তাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য বাইরে গাড়ি নিয়ে ওঁত পেতে আছে সেই পাচারকারীর দল। আবারো শুরু হল তার সেই বন্দী জীবন। তবে, এবার যখন তাকে কোনো খদ্দেরের বাড়ি পাঠানো হতো তখন সে শহরটাকে ভালমতো চেনার চেষ্টা করতো।

এভাবেই একদিন সে এই চক্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তার সাহায্য নিতে সক্ষম হয়। আর সেই পুলিশ কর্তাও ছিলেন সহৃদয় বান। তারপর এ ব্যক্তির সহায়তায় পাচারকারীরা একদিন গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু তাদের শাস্তি হয় মাত্র ২ বছরের জেল! এই শাস্তি আনা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি।

ইতোমধ্যে আনার মায়ের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। মেয়ের কাছ থেকে আনার মা জেনেছে তার দুঃখের কাহিনী। আর আনাও তার মায়ের কাছ থেকে জেনেছে, কত রকমের ভয়-ভীতির মধ্যে যে তিনি ছিলেন সেই সব ঘটনা।

আনা এখনো তার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে ক্ষত চিহ্ন। তার কোমরের নিচের অংশ এবং যৌনাঙ্গ ভীষণ রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার দুই হাঁটুতে আছে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা। আর মাথার পিছনের দিকের একটা জায়গা থেকে সব চুল উঠে গেছে। সেখানে আর নতুন চুল গজায়নি। কারণ মাথার পেছনে তার চুলের এই মুঠিটা ধরেই খদ্দেররা তার সাথে পশুর মত আচরণ করত। তাকে এতোবার পীড়ন করা হয়েছে যে এই জায়গাটা পুর পাকাপাকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে।

এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় আনার। এখনো তার কাছে মনে হয়, সে বুঝি বন্দী। এখনো নাকে এসে তার লাগে অ্যালকোহল, ঘাম, সিগারেট আর পুরুষের সেই উৎকট বীর্যের গন্ধ....।